বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকল্পে অপচয়, অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। বছরের পর বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানের ক্রয় ও কাজে পুকুর চুরির অভিযোগ রয়েছে। অথচ এত বিপুল খরচের পরও রেলের সেবার মান বাড়েনি। উল্টো রেল চলেছে পেছনের দিকে।
একটি রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানের যেখানে এত দিনে বিশ্বমানে পৌঁছানোর কথা, সেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচের পরও এর সেবার মান রয়ে গেছে তলানিতে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয় এবং সীমাহীন দুর্নীতি এখন আর নতুন কোনো খবর নয়। বাংলাদেশ সরকারি ক্রয় কর্তৃপক্ষের (বিপিপিএ) একটি প্রতিবেদন সেই চিত্রই আবারও স্পষ্ট করে তুলেছে। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এতে ৯ হাজার ২১ কোটি টাকার ৩০টি বড় রেলওয়ে প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় গুরুতর অনিয়ম ধরা পড়েছে।
সবচেয়ে হতাশাজনক দিক হলো, প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ না হলেও কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। উল্টো বারবার মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে আর সেই সঙ্গে বাড়ছে প্রকল্পের খরচ। উদাহরণ হিসেবে কমলাপুর থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন নির্মাণ প্রকল্পের কথা বলা যায়। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কাজ তিন বছরে শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কাজ হয়েছে মাত্র ৫৮ শতাংশ।
এর জন্য কোনো জরিমানা বা ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়নি। একইভাবে ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর রুটের একটি প্রকল্পের ব্যয় ৮৪৯ কোটি থেকে প্রায় তিন হাজার ৩৪৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এসব প্রকল্পে এমন অব্যবস্থাপনা প্রমাণ করে যে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার অভাব চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, রাজনৈতিক প্রভাবশালী, অসাধু প্রকল্প কর্মকর্তা এবং ঠিকাদারদের যোগসাজশেই এমন অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে। এর ফলে প্রতি কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ খরচ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আমাদের দেশে কয়েক গুণ বেশি, এমনকি ইউরোপের চেয়েও দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে।
আমরা মনে করি, প্রকল্প ব্যবস্থাপনার এই দুরবস্থা কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতিই করছে না, দেশের সার্বিক উন্নয়নের পথেও বাধা সৃষ্টি করছে। বিপিপিএর প্রতিবেদনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করা হয়েছে; যেমন—সময়সীমা কঠোরভাবে মেনে চলা, অযৌক্তিক বিলম্বের জন্য জরিমানা আরোপ এবং ক্রয়প্রক্রিয়ায় ই-জিপি শতভাগ চালু করা। সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব মো. কামাল উদ্দিন মনে করেন, যদি সরকার কঠোরভাবে এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করে, তবেই এ ধরনের অনিয়ম বন্ধ করা সম্ভব।
প্রকল্পে অনিয়ম, সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির দায় শুধু ঠিকাদারের নয়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের যোগসাজশও স্পষ্ট। তাই দায়মুক্তির সংস্কৃতি ভাঙতে হবে। অযৌক্তিক বিলম্ব ও ব্যয়বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কঠোর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে দায়ী কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে সরকারি সংস্থা আইএমইডি ও বিপিপিএকে শুধু সুপারিশে সীমাবদ্ধ না থেকে নিয়ম বাস্তবায়নে কঠোর হতে হবে।
কালের কণ্ঠের সম্পাদকীয়