মাননীয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উপদেষ্টা, একজন বিশেষজ্ঞ শিক্ষক হিসাবে অবশ্যই একমত হবেন, ছোট শিশুদের দেখ-ভাল করার জন্য পরিবারের এক বা একাধিক ব্যক্তি সবসময় দৃষ্টি রাখেন। নজর না রাখলে নানা দুর্ঘটনায় সংগঠিত হয়ে থাকে। শিশুদের অবুঝ প্রাণী বললে ভুল হবেনা। অবুঝ শিশুকে মানব শিশুতে রূপান্তরিত করা কঠিন কাজটি অবহেলিত প্রাথমিক শিক্ষকেরা করে থাকেন।
বিদ্যালয়ে শত-শত হাজার-হাজার শিশুদের হৈ চৈ চিল্লা-চিল্লি, ছোট-খাটো নালিশ এর মাঝে শিক্ষকদের মাথা সবসময় অস্থির অবস্থায় থাকে। এহেন পরিস্থিতিতে প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রতিনিয়ত ৭/৮টা ক্লাস নিতে হয়। শিক্ষক সংকটে একাধিক ক্লাস একসাথে নিতে হয়। শিশু শিক্ষায় প্রাথমিক শিক্ষকদের মস্তিষ্কের চাপ বা ক্ষয় বেশি হয়ে থাকে।কিন্তু আপনি সম্প্রতি প্রাথমিকে ‘অপ্রয়োজনীয় ছুটি আছে’ উল্লেখ করে সেগুলো কমানোর কথা বলেছেন। তাই আমাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে? অপ্রয়োজনীয় ছুটি বলতে কী বুঝায়?
এবারে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিশুবান্ধব সময়সূচি নিয়ে আলোকেপাত করছি।প্রাথমিক শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য শিশুর বয়স, রুচি ও সামর্থ্য অনুযায়ী মনোবিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা দেওয়া ও তাদের শারীরিক মানসিক বিকাশ সাধনের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করাসহ পাঠ্যবই তথা পরিবেশের সব খুটিনাটি বিষয়ে জানা।ছোট শিশুদের মানসিক চাপ দিয়ে মুখস্থ করার মাধ্যমে পরীক্ষায় বিশাল নম্বর অর্জন কাম্য নয়। শিশু শিক্ষার জন্য অতি প্রয়োজন শিশুবান্ধব সময়সুচি। এ সময়সূচিতে থাকতে হবে খেলাধুলা, বিনোদন, দুপুরে গরম খাবার খেয়ে বিশ্রাম অথবা ঘুমানো
অথচ প্রাথমিকের সময়সূচিতে শিশুদের দীর্ঘসময় বিদ্যালয়ে অনেকটা বন্দির মতো করে রাখা হয়। দীর্ঘ সময় ১ শিফট নামক বিদ্যালয়ে পাঠদান করায় তাদের মাঝে বিরক্তবোধ তথা লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ লোপ পায়। আমাদের দেশের অধিকাংশ শিশু পারিবারিক কাজে তথা অর্থ উপার্জনের সাথে জড়িত। অপরদিকে দুপুর বেলা বাড়িতে গরম খাবার খাওয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়। পাশাপাশি খাবার শেষে ঘুমানো বা বিশ্রাম নেওয়া সম্ভব হয় না। বিকেল বেলা ক্লান্ত শরীরে পড়ন্ত বেলায় খেলাধুলা বা বিনোদনের করার কোন সুযোগ হয়ে উঠেনা।
অপরদিকে বেসরকারি ও সরকারি উচ্চ বিদালয়ের প্রাথমিক শাখাসহ কিন্ডারগার্টেনের মতো শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১১/ ১২/১ টা সর্বাধিক ২টা মধ্যে পাঠদান সমাপ্ত করে থাকে। যার ফলে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করায় না। শিক্ষার্থী কম থাকায় সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক মা সমাবেশ, বাবা সমাবেশ ইত্যাদি আয়োজন করতে হয়। অভিভাবক ও তাদের সন্তানদের ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবতে হয়।
আমাদের দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা তথা শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে দুপুর ২টার মধ্যে পাঠদান সমাপ্ত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি সকল শিশুর জন্য অভিন্ন সময়সূচি, বই, সময়মত দুপুরের গরম খাবার খাওয়া, ঘুম তথা বিশ্রাম , বিকেল বেলা খেলাধুলা বা বিনোদনের সুযোগ কাম্য । টাকা পয়সার বিনিময়ে ধনি শ্রেণির অভিভাবকদের সন্তানরা এ সুযোগ ভোগ করবে। শিশুর প্রতি এ বৈষম্য মোটেই কাম্য নয়।
প্রবাদ আছে ‘বিশ্রাম কাজের অংগ, একসাথে গাঁথা, নয়নের পাতা যেন নয়নে গাঁথা।’ আমরা সকলে গভীরভাবে সকলে উপলব্ধি করলে প্রবাদটির অর্থ নিজেদের জীবনের সাথে মিলিয়ে দেখতে পারি। শিশু শিক্ষা শিশু তথা শিক্ষকের জন্য যন্ত্রণাদায়ক ও কষ্টের কাজ। এ পেশাকে আনন্দময় করার প্রয়াসে অন্যান্য শিক্ষাকতা পেশার যথাক্রমে হাইস্কুল, কলেজ তথা উচ্চ শিক্ষার চেয়ে প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেশি বিশ্রাম দরকার । আরেকটা কথা আদিকাল থেকে শুনে আসছি, প্রাথমিক শিক্ষকদের ১০ বছর শিক্ষকতা করার পর আদালতে তাদের স্বাক্ষী নেয়না। কারণ শিশুদের পাঠদান, হৈ চৈ চিল্লা- চিল্লির মাঝে শিক্ষকদের বুদ্ধি ক্ষয় হয়ে এমন পর্যায়ে আসে , তাদের স্বাভাবিক কথা বলার গতি অনেকটা লোপ পায়। এজন্য শিক্ষকদের একনাগাড়ে ক্লাসের চাপ কমিয়ে এক পিরিয়ডের পর এক পিরিয়ড বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন।
মাত্রাধিক পড়ার চাপে শিশুদের তাদের লেখাপডার প্রতি আগ্রহ লোপ পাবে। মাননীয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মহোদয় কাছে জানতে চাই , শিক্ষক হিসাবে আপনি বড়দের একনাগাড়ে কয়টা ক্লাস নিতেন। আদিকাল থেকেই তৎকালীন বিশেষজ্ঞরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি নির্ধারণ করেছেন। এখন শিক্ষকদের ওপর অমানবিক পাঠদান তথা অমানবিক কাজের চাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। আপনি হয়তো বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মতো, পবিত্র রমজান উপলক্ষে দীর্ঘ ১মাসের ছুটি নিয়ে ভাবছেন। পবিত্র রমজান মাসে সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমান সম্প্রদায়ের শিক্ষকেরা রোজা রাখেন। অধিকাংশ শিশু শিক্ষাথীরাও রোজা রাখেন, নামাজ পড়েন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার রোজার মাসে ক্লাস করিয়ে ধর্মপরায়ন মানুষের মনে আঘাত করেছিল। বিষয়টি মনে রাখা দরকার।