মহানবী (সা.) যে স্থানে শুয়ে আছেন, সেটি মূলত উম্মুল মুমিনিন আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর হুজরা বা কক্ষ। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অন্তিমশয্যা কোথায় হবে, তা নিয়ে সাহাবিদের ভেতর মতভিন্নতা ছিল। কিন্তু আবু বকর (রা.) বলেন, ‘আমি নবীজি (সা.)-কে বলতে শুনেছি যে কোনো নবীকে (পৃথিবী) থেকে ওঠানো হয়নি (মৃত্যুবরণ করেননি), তাঁকে সেই স্থানে দাফন করা ছাড়া যেখানে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।’ এই মীমাংসার পর নবী (সা.) যে বিছানায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন, আবু তালহা (রা.) তা উঠিয়ে নিলেন।
অতঃপর তার নিচে বগলি কবর খনন করা হলো এবং তাঁকে দাফন করা হলো।
সঙ্গী হলেন দুই সহচর
১৩ হিজরিতে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ইন্তেকাল করলে তাঁকে নবীজি (সা.)-এর পাশে দাফন করা হলো। ২৪ হিজরিতে ওমর (রা.)-কেও তাঁদের পাশে দাফন করা হয়। তিন কবরের মধ্যে ব্যবধান এক গজ করে।
মহানবী (সা.)-এর বুক বরাবর আবু বকর (রা.)-কে এবং তাঁর বুক বরাবর ওমর (রা.)-কে দাফন করা হয়। তাঁদের সবার মাথা মসজিদে নববীর দিকে, পা জান্নাতুল বাকির দিকে এবং চেহারা কিবলার দিকে। মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পরও আয়েশা (রা.) আমৃত্যু নিজ ঘরে বসবাস করেন। ওমর (রা.)-কে দাফন করার পর ঘরের অবশিষ্ট জায়গায় আয়েশা (রা.) কাপড় টাঙিয়ে বসবাস করতেন।
(মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৫৬৬০)
আয়েশা (রা.)-এর ইন্তেকালের পর মসজিদে হুজরা মোবারকে প্রবেশের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
রওজা মোবারকের আয়তন
আয়েশা (রা.)-এর ঘরের দুটি অংশ ছিল। একটি অংশ ছিল ছাদযুক্ত। যার দেয়ালের উচ্চতা ছিল দুই মিটার এবং ঘরের মোট আয়তন ছিল ১৭.৭৫ বর্গমিটার (প্রায় ৬০ বর্গফুট)। সঙ্গে একটি অংশ ছিল ছাদহীন।
এই অংশের দেয়ালের উচ্চতা ছিল ১.৬ মিটার এবং এটি ২.৫ মিটার প্রশস্ত এবং ৫.২৪ মিটার দীর্ঘ ছিল। মসজিদে নববী ও হুজরা শরিফের ভেতর একটি দরজা ছিল।
রওজা মোবারকের দরজা
বর্তমানে হুজরা মোবারকে কারো প্রবেশের সুযোগ নেই। কেননা তার চারপাশ দরজাহীন দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এই দেয়ালের বাইরে আরেকটি বেষ্টনী রয়েছে, যাকে বলা হয় মাকসুরা। এই বেষ্টনীতে একাধিক দরজা রয়েছে, যার কয়েকটি বর্তমানে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। দক্ষিণ দিকের দরজাকে বলা হয় বাবুত তাওবা, উত্তর দিকের দরজাকে বলা হয় বাবুত তাহাজ্জুদ, পূর্ব দিকের দরজাকে বলা হয় বাবুল ফাতেমা এবং পশ্চিম দিকের দরজাকে বলা হয় বাবুন নাবি, এটি বাবুল উফুদ নামেও পরিচিত। কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি মদিনায় আগমন করলে মাকসুরার বাবে ফাতেমা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে পারে।
অবকাঠামোগত পরিবর্তন
রওজা মোবারকের অবকাঠামোতে একাধিকবার পরিবর্তন এসেছে এবং তা সংস্কার করা হয়েছে। প্রথম পরিবর্তন আসে ১৭ হিজরতে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর যুগে। তিনি হুজরার খেজুরগাছের দেয়াল সরিয়ে একটি পাকা দেয়াল নির্মাণ করেন। এরপর খলিফা ওমর ইবনুল আবদুল আজিজ (রহ.) ’৮৮ ও ’৯১ হিজরিতে নবীজি (সা.)-এর স্থাপিত দেয়ালের স্থানে কালো পাথরের দেয়াল তৈরি করেন। তবে তা যেন কাবাঘরসদৃশ না হয়, সে জন্য তিনি চার কোণের পরিবর্তে পঞ্চকোণবিশিষ্ট দেয়াল নির্মাণ করেন। তাঁর নির্মিত দেয়াল ছিল সম্পূর্ণ দরজাহীন।
৫৫৭ হিজরিতে বাদশাহ নুরুদ্দিন আদিল আশ-শহীদ হুজরার চারপাশে একটি পরিখা খনন করেন এবং তাতে সিসা ঢেলে দেন, যেন পবিত্র দেহ মোবারকের কাছে কেউ পৌঁছতে না পারে। ৬৬৮ হিজরিতে বাদশাহ রোকনুদ্দিন জাহির বাইবার্স রওজা পাকের চারপাশে কাঠের কাঠামো নির্মাণ করেন, যাতে একটি জালিসহ তিনটি দরজা ছিল। ৬৯৪ হিজরিতে মালিক আদিল জাইনুদ্দিন কুতবুগা কাঠের ঘেরাকে ছাদ পর্যন্ত বর্ধিত করেন। ৬৭৮ হিজরিতে সুলতান মুহাম্মাদ ইবন কালাউনের আমলে হুজরার ওপর একটি গম্বুজ নির্মিত হয়, যার নিচের অংশ ছিল চতুর্ভুজ এবং ওপরের অংশ অষ্টভুজাকৃতির। এটি সিসার পাত দিয়ে আবৃত ছিল।
৮৮৬ হিজরিতে অগ্নিকাণ্ডের ফলে গম্বুজটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৮৮৭ হিজরিতে সুলতান কায়িতবা গম্বুজটি পুনর্নির্মাণ করেন। তখন ইটের তৈরি মজবুত ভিত নির্মাণ করা হয়। হুজরা মোবারকের দক্ষিণ দিকে তামার জানালা স্থাপন করা হয়, যার ওপরের অংশ ছিল তামার তৈরি জাল দিয়ে আবৃত। আর উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম দিকের জানালাগুলো ছিল লোহার, যেগুলোর ওপরের অংশে তামার জালি ছিল।
১২৩৩ হিজরিতে সুলতান মাহমুদ ইবন আবদুল হামিদের শাসনামলে গম্বুজটি সর্বশেষবারের মতো পুনর্নির্মাণ করা হয়। তখন এটি আবার ফেটে গিয়েছিল, তাই তিনি তার উপরিভাগ ভেঙে নতুন করে নির্মাণের নির্দেশ দেন। সেই গম্বুজ এখনো টিকে আছে। ১২৫৩ হিজরিতে, ওসমানি সুলতান আবদুল হামিদ গম্বুজটিকে সবুজ রং করার নির্দেশ দেন। এর পর থেকে এটি সবুজ গম্বুজ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
রওজা পাকের বর্তমান কাঠামো উসমানীয় আমলে তৈরি। ১৯১৭ সালে মদিনায় নিযুক্ত উসমানীয় গভর্নর ফাখরি পাশা এটি নির্মাণ করেন। সৌদি আরব প্রতিষ্ঠার অবকাঠামোতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। তবে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়েছে।
তথ্যঋণ : বই—রওজা পাকের ইতিকথা ও রাসুলের রওজা; সৌদিপিডিয়া ডটকম, উইকিপিডিয়া ও ইসলাম কিউএ ডটইনফো